বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তথ্য

১)চাকমা:

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী দাবীদার জুম্ম জনগোষ্ঠীর অন্যতম চাকমা জনগোষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলাতেই চাকমাদের বসবাস রয়েছে। চাকমারা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। তবে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে অধিক চাকমা বসবাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলায় চাকমাদের মোট জনসংখ্যা ২,৩৯,৪১৭ জন । ঐ সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রায় ৬০ হাজার চাকমা শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছিল বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে- যাদের গণনায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। বাংলাপিডিয়া মতে, আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিষ্টব্দের দিকে পর্তুগিজ মানচিত্র প্রণেতা লাভানহা অঙ্কিত বাংলার সর্বাপেক্ষা পুরাতন ও এ পর্যন্ত অস্তিত্বশীল মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চাকমাদের সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। কর্ণফুলীর নদীর তীর বরাবর চাকমাদের বসতি ছিল। চাকমাদের আরো আগের ইতিহাস সম্পর্কে দুটি তাত্ত্বিক অভিমত প্রচলিত। উভয় অভিমতে মনে করা হয়, চাকমারা বাইরে থেকে এসে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বসতি স্থাপন করে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক অভিমত অনুযায়ী, চাকমারা মূলত ছিল মধ্য মায়ানমারের আরাকান এলাকার অধিবাসী। তবে বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, কিংবদন্তী অনুযায়ী অতীতে চাকমারা চম্পকনগর নামে একটি রাজ্যে বাস করত। চম্পক নগর ত্রিপুরা রাজ্যেরই কাছাকাছি কোন জায়গায় অবস্থিত ছিল। এ ব্যাপারে নানা সাক্ষ্যও পাওয়া যায়। অশোক কুমার দেওয়ানের অনুমানে উত্তর ত্রিপুরার কোন স্থানে বসবাসকারী চাকমারা সেখানে আনুমানিক দুশ থেকে আড়াইশ বছর কাল অতিবাহিত করার পর পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্বদিকে সরে আসতে থাকে এবং পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং তার উপনদীসমূহের উপত্যকা ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই হিসাব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন ৫০০ বছরের বেশি নয়। চাকমা রাজবংশের ইতিহাস অনুযায়ী বিজয়গিরিকে ১ম রাজা ধরলে ৩২/৩৩ তম রাজা হচ্ছেন অরুণযুগ (ইয়াংজ )। তার শাসনকাল আনুমানিক ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দ। চাকমা ঐতিহাসিকদের মতে অরুণ যুগের পতনের পরপরই অর্থাৎ ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমারা বার্মা থেকে চট্টগ্রামে বা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন ।

২) ত্রিপুরা:

বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, বৃহত্তর চট্টগামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বর্তমানে বসবাস করে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে একসময় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী যে সবর্ত্র ছিল ১৮৭২ ও ১৮৮১ সালের আদমশুমারী প্রতিবেদন পরীক্ষা করলে তার প্রমাণ মেলে। ১৮৭২ সালে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা ছিল ১৫,৬৩২ জন যা ১৮৮১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮,৫০৯ জনে। বর্তমানে বাংলাদেশে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা অনেকেই মনে করেন দুই লক্ষের কাছাকাছি। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। বাংলাপিডিয়া মতে, এরা ছিল বর্তমান বারীয় রাজ্য ত্রিপুরার পার্বত্য এলাকার অধিবাসী। পরবর্তীতে এরা নিজ এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশের মূলত কুমিল্লা, সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে। অনেকের মতে, টিপরারা আসাম, বার্মা এবং থাইল্যাণ্ডের অধিবাসী সাধারণ এক উপজাতির পূর্বপুরুষ বডো জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, এ জাতির মূল অংশ বাস করছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও ভারতের মিজোরাম , আসাম প্রভৃতি প্রদেশেও অনেক ত্রিপুরা বাস করে। মিয়ানমারেও ত্রিপুরাদের জনবসতি আছে বলে জানা যায়। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস থেকে জানা যায় আনুমানিক ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুই বংশের সময়কালে পশ্চিম চীনের ইয়াংসি ও হোয়াংহো নদীর উপত্যাকা হচ্ছে এদের প্রাচীন আবাসস্থল। পরবর্তীতে এই জনগোষ্ঠী ভারতের আসাম হয়ে বর্তমান বসতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়।

৩) মারমা:

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে মারমাদের সবচেয়ে বেশি লোক বান্দরবান জেলায় বাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হচ্ছে ১,৪২,৩৩৪ জন। বাংলাপিডিয়া মতে, মারমা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বার্মিজ শব্দ ‘মায়ানমা’ থেকে, যার অর্থ বার্মার অধিবাসী। মারমা জনগণের পূর্ব পুরুষগণ বার্মার পেগু নগরে বসবাস করতেন। আরাকান রাজার সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মহাপিন্নাগি ১৫৯৯ সালে বার্মায় একটি আগ্রাসন পরিচালনা করেন। তখন তারা বঙ্গীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা শ্রী সুধাম্মার ( শ্রীসুধর্ম ) মৃত্যুর পর তার এক অমাত্য নরপতি আরাকানের সিংহাসন দখল করে রাজপরিবারের সদস্য ও পণ্ডিতদেরকে মৃতুদণ্ড দিতে থাকলে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে। দেশের এই রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় রাজার পুত্র নাগাথোয়াইখিন রাজপরিবারের সদস্যবর্গ ও পণ্ডিতদের নিয়ে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যান। এসময় তিনি চট্টগ্রামের কাইসাঁ জায়গায় আশ্রয় নেন। প্রায় ৫০০০০ সৈন্য তাকে অনুসরন করে। কাইসাঁ বা কর্ণফুলী নদীর তীরে বাস করতে থাকে। নাগাথোয়াইখিন কাইঁসা অঞ্চলের শাসক হিসেবে বা ম্রাইমাগ্রি মাঙঃ বা ম্রাইমাগ্রিদের রাজা হিসেবে পরিচিতি পান। আরাকানের নতুন রাজা নাগাথোয়াইখিন এর অবস্থান জানার পর শত্রুতার পথে না গিয়ে তাকে কাইসাঁ অঞ্চলের শাসক হিসেবে স্বীকিৃতি দেন।১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা থেকে আরাকানি শাসনের পতন হলে মোগল শাসণাধীনে মারমাদের পেলেংসা: গোত্র মোগলদের কর প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের স্থায়ী আবাসভূমি গড়ে তুলেছিল। ১৭৮২ সালের দিকে তারা পেলেংসা: রাজবংশের পূর্বসূরী ম্রাচাই ধাবইং এর নেতৃত্বে সীতাকুন্ড এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ধাবইং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে কার্পাস মহলের কর আদায়ের চুক্তি অনুসারে ঐ এলাকার চিফ পদ লাভ করেন।

৪) মণিপুরী :

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের শিকার হয়ে এবং যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়, ত্রিপুরা রাজ্যে এবং বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরী অভিবাসন ঘটে। বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ সিলেটে আশ্রয়গ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই স্বদেশে ফিরে যায়, কিন্তু বহু মণিপুরী তাদের নতুন স্থানে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। বাংলাদেশে আসা মণিপুরীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, ঢাকার মণিপুরী পাড়া এবং প্রধানত বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে।বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে ভাষাগত এবং ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের মণিপুরীরা তিনটি শাখায় বিভক্ত এবং স্থানীয়ভাবে তারা (১) বিষ্ণুপ্রিয়া, (২) মৈতৈ ও (৩) পাঙন নামে পরিচিত। মণিপুরের অধিবাসীদের মধ্যে এই তিনটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের শিকার হয় এবং তারা বাংলাদেশে এসে পাশাপাশি বসতি স্থাপন করে। বিষ্ণুপ্রিয়ারা ককেশয়েড মহাজাতির আর্য-ভারতীয় উপপরিবারের অন্তর্গত এবং তাদের ভাষার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা। মৈতৈরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের অন্তর্গত এবং তাদের ভাষার নাম মৈতৈ। পাঙনরা আর্য বংশদ্ভুত হলেও মৈতৈ ভাষায় কথা বলে এবং ধর্মীয়ভাবে তারা মুসলিম। বাংলাদেশের মণিপুরীদের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এসআইএল ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া জনসংখ্যা ৪০ হাজার এবং মণিপুরী মৈতৈ জনসংখ্যা ১৫ হাজার। ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য নেই। মণিপুরীদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। মণিপুরী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মণিপুরীদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান বেশি। বছরের শুরুতে হয় মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিষু এবং মৈতৈদের চৈরাউবা উৎসব। আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও কাঙ উৎসবের সময় প্রতিরাত্রে মণিপুরী উপাসনালয় ও মন্ডপগুলোতে বৈষ্ণব কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাচ ও গানের তালে পরিবেশন করা হয়। কার্ত্তিক মাসে মাসব্যাপী চলে ধর্মীয় নানান গ্রন্থের পঠন-শ্রবন। এরপর আসে মণিপুরীদের বৃহত্ম উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরন বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রী: থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের ল ল ভক্ত-দর্শক মৌলবীবাজার জেলার সিলেটের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডবের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষনে ছুটে আসেন। বসন্তে দোলপূর্ণিমায় মণিপুরীরা আবির উৎসবে মেতে উঠে। এসময় পালাকীর্ত্তনের জনপ্রিয় ধারা "হোলি" পরিবেশনের মাধ্যমে মণিপুরী তরুণ তরুণীরা ঘরে ঘরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এছাড়া খরার সময় বৃষ্টি কামনা করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি ডাকার গান পরিবেশন করে থাকে।

৫) ম্রো :

ম্রো পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন জাতি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। ম্রোদের আদি নিবাস মায়নামারের আরাকান রাজ্য। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ম্রোরা মূলতঃ প্রকৃতি পূজারী হলেও অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে কয়েক বছর আগে ম্রোদের মধ্যে একটা নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’ আর্বিভাবের ফলে বর্তমানে ম্রোদের একটি অংশ ক্রামা ধর্মের অনুসারি। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মুরুং উপজাতিরা আরকান থেকে পালিয়ে আলীকদমের বিভিন্ন পাহাড়ী উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে বার্মার আকিয়াব জেলায় এখনো মুরুং উপজাতীয় বসতি বিদ্যমান বলে জানা যায়।

৬) সাওতাল :

সাঁওতাল বা মান্দি পূর্বভারত ও বাংলাদেশের সবচেয়েবড় আদিবাসী নৃগোষ্ঠীগুলির একটি। এরা নিজেদেরকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ রচিত মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যিত-ভাব শিষ্য একলব্যের বংশধর বলে বিশ্বাস করে এবং তীরচালনাকালে এখনও নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যবহার করে না কারণ তাদের আদিপুরুষ একলব্যকে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দান করেছিলেন । সান্তাল , সান্তালি , হোর , হর , সাঙ্তাল , সান্দাল , সন্থাল , সান্থাল , সান্তালি , সাতার প্রভৃতি অভিধায়ও এ নৃগোষ্ঠী অভিহিত হয়ে থাকে ।

৭) মুন্ডা :

বাংলাদেশে মুন্ডাদের আগমন ও তাদের বসতি বিন্যাসের প্রকৃত তথ্য এ যাবতকালে উৎঘাটিত না হলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং উৎখননের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বিহারে ও রাঁচিতে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে মোটামুটিভাবে তাদের আদি বসতি বিন্যাসের সময়কাল এবং স্থান নিরূপণ করা সম্ভব। সম্ভবত ২০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে এবং তার পরবর্তীকালে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি মুন্ডা সম্প্রদায়ভূক্ত বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী মানব গোষ্ঠী নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, মুন্ডা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী বিদেশী প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত একটি বিচ্ছিন্ন মানব গোষ্ঠীর কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সূত্র ধরেই তাদের গোষ্ঠী চিন্তা প্রসারিত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশে বসবাসরত মুন্ডা সম্প্রদায়ের বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী মানব গোষ্ঠী বাংলাদেশের খুলনা জেলার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মুন্ডাদের বসতি বিন্যাসের এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন এলাকায়ও এদের আদি বসতির চিহ্ন মিলে। জাতিতাত্ত্বিক দিক থেকে ছোট নাগপুরের বৃহত্তর দ্রাবিড় উপজাতি হিসাবে উল্লেখ করা হলেও প্রাকৃতিক অর্থে বাংলাদেশের মৌলভী বাজার অঞ্চলের যে সমস্ত মুন্ডাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাতে বিষয়টি বিশেষ করে তাদের দৈহিক কাঠামোগত বিন্যাস, পরিবেশ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জেনেটিক ডেরিফের কারণে দ্রাবিড় উপজাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী মনে হয়।

৮) তঞ্চঙ্গা :

পার্বত্য চট্টগ্রামের কতিপয় পাহাড়ি জাতির মতো তনচংগ্যাদের আবাসভূমিও গড়ে ওঠে নদী সংলগ্ন উপত্যকায়। পার্বত্য চটগ্রামের রাঙামাটি জেলার কাউখালি উপজেলার রইস্যাবিলি ও কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনার আশেপাশের এলাকায়, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায়, কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে তনচংগা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলেও তনচংগাদের আবাসভূমি রয়েছে। মায়ানমারের আরাকান এবং ছিন রাজ্যের এবং ইয়াংগুন শহরেও তনচংগ্যা রয়েছে। সেখানে তারা ‘দোইনাক’ নামে পরিচিত। নৃ-ত্বাত্বিক ব্যাখ্যায় তনচংগ্যারা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর লোক। তনচংগ্যা জনগোষ্ঠী ভারতীয় আরয ভাষার অন্তরগত পালি, প্রাকৃত, আদিবাংলা ভাষায় কথা বলে। তনচংগ্যাদের স্বভাব বেশ নম্র। তারা কিছু লাজুক স্বভাবেরও বটে। তনচংগাদের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পোশাক রয়েছে। তনচংগা নারী তাদের নিজস্ব পোশাকে দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। পাহাড়ি নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার পরিধান করে তনচংগা নারী। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে বৈচিত্র্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তনচংগা রমণীর পরনে থাকে প্রথমত সাত রঙের পিনুইন বা পিনন। পিননের দুই প্রান্তে লম্বালম্বি স্ট্রাইপ, মাঝখানে দুই প্রান্তে রঙের লম্বালম্বি স্ট্রাইপ এবং সমগ্র পিননে বিভিন্ন রঙের সুতার স্ট্রাইপ থাকে। তনচংগা রমণীরা অতীতে নানা ধরনের অলংকার পরত। তাদের ব্যবহৃত অলংকারের মধ্যে কানে রাজ্জু ও ঝংকা, কবজিতে বাঘোর, কুচিখারু, বাহুতে তাজজুর, গলায় চন্দ্রহার, হাচুলি, সিকছড়া প্রভৃতি উল্লেখযগ্য। এসব অলংকার সাধারণত রুপা দিয়ে তৈরি।

৯) বম :

অতীতে বম জনগোষ্ঠীর লোকজন নদী থেকে দূরে দুর্গম পর্বত শিখরে তাদের গ্রামগুলি নির্মাণ করত। গ্রামগুলির চারপাশে শক্ত গাছের খুঁটি পুঁতে বেষ্টনী তৈরি করা হতো। বমরা মাটিতে খুঁটি পুঁতে উঁচু পাহাড়ের উপর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাতে বাড়িঘর নির্মাণ করে। তাদের ঘরকে মাচাং বলা হয়। মাচাং বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার সালিশ এবং বিবাদ মীমাংসার জন্য এদের নিজস্ব সামাজিক অবকাঠামো আছে। এই কাঠামো সামগ্রিকভাবে সামাজিক আচার-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বম সমাজের কেউ এ যাবৎ নিজেদের মধ্যে সংঘটিত কোন বিবাদ মীমাংসার জন্য আদালত বা অন্যকোন সরকারি সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছে বলে জানা যায় না। আজও বমরা তাদের জীবন পরিচালনা করে বম কাস্টমারি ল’ গ্রন্থের নির্দেশিকা অনুযায়ী। বমদের বাঁশনৃত্য তাদের জীবনেরই অপরিহার্য অংশ। এটি পরিবেশ থেকে নেওয়া নৃত্যানুষ্ঠান। বমদের চেরাউ নৃত্য ও সঙ্গীত আসলে কোন আনন্দের বা উৎসবের নৃত্য বা গান নয়। এ নৃত্য ও গান পরিবেশিত হয় বম পরিবারের দুঃখ ও শোকের দিনে। বিশেষ করে পরিবারের কারও অকাল বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে এই গান করা হয়। শোকের সময় মানুষকে সান্ত্বনা ও সাহস দেওয়ার এটাই বমদের রীতি।

১০) গারো :

গারো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় ও বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়। ভারতে মেঘালয় ছাড়াও আসামের কামরূপ, গোয়ালপাড়া ও কারবি আংলং জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ছাড়াও টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকাও গাজীপুরজেলায় গারোরা বাস করে। গারোরা ভাষা অনুযায়ী বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে অনেক গারোই নিজেদেরকে মান্দি বলে পরিচয় দেন। গারোদের ভাষায় 'মান্দি' শব্দের অর্থ হল 'মানুষ'।[২] গারোদের সমাজে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা প্রচলিত। তাদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের নাম 'ওয়ানগালা'; যাতে দেবতা মিসি আর সালজং এর উদ্দেশ্যে উৎপাদিত ফসল উৎসর্গ করা হয়। উল্লেখ্য ওয়ানগালা না হওয়া পর্যন্ত মান্দিরা নতুন উৎপাদিত ফসলাদি খেত না। আশ্বিন মাসে একেক গ্রামের মানুষদের সামর্থ্যানুযায়ী সাত দিন কিংবা তিনদিন ধরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। অতীতে গারোরা সবাই তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করত। তাদের আদি ধর্মের নাম ‌'সাংসারেক'। ১৮৬২ সালে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বর্তমানে ৯৮ ভাগ গারোরাই খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তাদের সামাজিক নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠানে বেশ পরিবর্তন এসেছে। গারোদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এছাড়াও অন্যান্য দেবতারা হলেন- মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়া প্রমুখ। বিভিন্ন গবেষকগণ বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি গারো বর্ণমালা আবিষ্কার করেছেন। সেগুলো উচ্চ গবেষণার জন্য বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি-তে সংরক্ষণ করা আছে। বাংলাদেশি গারোরা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল,শূকর প্রভৃতি খায়। মদ তাদের অপরিহার্য পানীয়। বর্তমানে গারোরা লেখাপড়া ও চাকুরি করার সুবাদে বিভিন্ন স্থানে গমন এবং দেশীয় লোকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠাই দেশীয় খাবারগুলো নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি খাবার খেতে ভালোবাসে। গারোদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে-নাখাম কারি। যা পুটি মাছের শুটকি দিয়ে তৈরি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শুকুরের মাংস গারোদের অতি প্রিয়। বাংলাদেশে বসবাসকৃত বর্তমান গারোদের ৯০% ধর্মান্তরিত খিষ্ট্রান। প্রায় ২% মুসলিম ও হিন্দু এবং বাকি ১০% ঐতিহ্যবাহী ধর্ম পালন করে(২০০৮ সালের তথ্যমতে)। গারোদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম সংসারেক। এর অর্থ কেউ জানে না। তবে গবেষকদের মতে সম্ভবত বাংলা সংসার থেকে সংসারেক শব্দটি এসেছে। গারোরা হিন্দু ধর্মালম্বীদের মত পূজা করে থাকে। তাদের প্রধান পূজা ‘ওয়ানগালা’। সালজং(Saljong) তাদের উর্বরতার দেবতা এবং সূর্য সালজং এর প্রতিনিধি। ফসলের ভালোমন্দ এই দেবতার উপর নির্ভর করে বলে তাদের বিশ্বাস। সুসাইম(Susime) ধন দৌলতের দেবী এবং চন্দ্র এই দেবীর প্রতিনিধি। গোয়েরা(Goera) গারোদের শক্তি দেবতার নাম। কালকেম(Kal Kame) জীবন নিয়ন্ত্রণ করে বলে গারোদের বিশ্বাস।

১১) ওরাঁও :

ওরাওঁ আদিবাসীরা নৃতাত্ত্বিক বিচারে আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রেলীয়) জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরূষ। নৃতত্ত্ববিদগণের মতে একই অম্ফলের মুণ্ডা, মালপাহাডি় ও সাঁওতালদের সঙ্গে ওরাওঁদের ঘনিষ্ঠ জনতাত্ত্বিক সম্পর্ক রযে়ছে। ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক সোসাইটির মতানুসারে কুরুখ জাতি বা ওঁরাওদের আদিবাস ছিলো কঙ্কন অঞ্চলে যেখান থেকে তারা অভিবাসিত হয়ে উত্তর ভারতে চলে আসে। কঙ্কনি ভাষার সাথে কুরুখ ভাষার উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী জেলা ওরাওঁদের প্রধান বসতিস্থল। তবে ১৮৮১ সালের লোকগণনায় দেখা যায় যে, উত্তরবঙ্গ ছাড়াও তখন ময়মনসিংহ, চল্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলায় কিছুসংখ্যক ওরাওঁ আদিবাসীর বসতি ছিল। অনেক আদিবাসী জাতির মতো ওরাওঁ সমাজও সর্বপ্রাণবাদী প্রকৃতি উপাসক। তবে তাদের ধর্মবিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সর্বশক্তিমান ‘ধরমেশ’ স্বীকৃত। এই সর্বশক্তিমানের অবস্থান সূর্যে। তাই ধর্মীয় অনুষ্ঠান অধিকাংশই সূর্যকে ঘিরে উদযাপিত হয়। এছাড়া ওরাওঁ সমাজ নানা দেবতায় বিশ্বাসী। ঐসব দেবতার প্রতীকী অবস্থান গ্রাম, কৃষিসমপদ, অরণ্য, মহামারী ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে। এদের তুষ্টির জন্য রযে়ছে ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। কোন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে হিন্দুদের পূজার মিল পাওয়া যায়, যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘ভাদু’ উৎসবের সঙ্গে ওরাওঁদের ‘করম’ উৎসবের মিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কদম শাখাকে ঘিরে অনুষ্ঠিত এ উৎসবটি বৃক্ষপূজার নামান্তর।

১২) চাক :

চাক বাংলাদেশের একটি উপজাতি। বাংলাদেশের বান্দরবান, চট্টগ্রামের চাক পাহাড় ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসবাস রয়েছে। চকরা যে ভাষায় কথা বলে সেটি চাক ভাষা নামে পরিচিত। চাকদের ভাষায় 'চক' শব্দের অর্থ 'দাঁড়ানো'। চাকরা নিজেদের নামের শেষে চাক লিখলেও আরাকানিরা চাকদের 'সাক' (Sak) এবং কখনো কখনো 'মিঙচাক' বলে ডাকে। চাকরা অবশ্য নিজেদের বলে 'আচাকঃ'। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে চকদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার, মিয়ানমারে ২০ হাজার (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০০২)। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইশারি, নাইক্ষ্যংছরি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গায় চাক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। নামগত সাদৃশ্য ছাড়া চাকমাদের সাথে এদের ভাষা বা সংস্কৃতিগত কোনো মিল নেই। চাকরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তবে অনেক খ্রিষ্টধর্মালম্বীও আছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকদের মধ্যে প্রধাণত দুটি গোত্র দেখা যায়ঃ 'আন্দো' ও 'ঙারেখ'। এই দুটি প্রধান গোত্রের মধ্যে আবার অনেকগুলো উপগোত্র আছে। একই গোত্রের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ।

১৩) লসুাই :

লুসাই একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তারা পূর্ব বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মায়ানমারে বসবাস করে। তারা নিজেদের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলে পরিচয় দেয়। তাদের অধিকাংশই পাহাড়ে জুম চাষ করে। লুসাই পাহাড়ের নামেই তাদের নামকরণ হয়েছে। লুসাইদের চাকমারা ‘কুগী’, মারমারা ‘লাঙ্গী’ ও ত্রিপুরারা ‘শিকাম’ নামে অভিহিত করে। কিংবদন্তী অনুসারে চীন দেশের রাজা চিনলুং তাঁর বাবার সাথে মতের অমিল থাকার কারণে তাঁর অনুসারিদের নিয়ে বার্মায় (মিয়ানমার) চলে আসেন এবং সেখানে গ্রাম তৈরি করে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে উক্ত রাজার বংশধররা চিনহিলস, মনিপুর, কাছাড়, মিজোরাম, সাতিকাং (চিটাগাং) অঞ্চলে প্রায় দুশত বছর রাজত্ব করেন। এই রাজার উত্তরসূরী যাম্হুয়াকার রাজত্বকালে তাঁরা বঙ্গ দেশের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। লুসাইরা অতীতে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করতো। পরবর্তীকালে তুলা থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি ‘হ্নখাল’ নামে একধরণের চাদর প্রথমে লুসাই পুরুষরা এবং পরে নারীরা ব্যবহার শুরু করে। সময়ের পরিবর্তনে মহিলারা কোমর-তাঁত দিয়ে ‘পুয়ানফেল’ (থামি), ‘করচুং’ প্রভৃতি এবং পুরুষরা ‘করচুর’ (শার্ট) ও পুয়ানবি (লুঙ্গি) তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করে। এছাড়া লুসাই নারীরা বিভিন্ন ধরনের থামি যেমন পুয়ান রৌপুই, পুয়ান চেই, পুয়ানদুম, ঙৌতে খের পরিধান করেন। লুসাই নারীরা বিভিন্ন নকশার অলংকার দিয়ে নিজেদের সাজাতে পছন্দ করেন। তারা দামী পাথরের মালা পরেন। লুসাই সমাজে বিয়েতে পণ প্রথা বিদ্যমান। অতীতের রীতিনীতি অনুসারেই কনে বিয়ের ২/১ দিন আগেই পিতামাতা আত্মীয়স্বজনসহ প্রথমে পালাই-এর বাড়িতে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। পালাই শুকর কেটে তাদের ভোজের ব্যবস্থা করে। বিয়ের দিন বরপক্ষ পালাই-এর বাড়ি থেকে কনেকে নিয়ে এসে প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে গীর্জায় গমন করে। গীর্জায় তাদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হওয়ার পরে বরের বাড়িতে সকল আত্মীয়স্বজন যায় এবং সেখানে ভোজের আয়োজন করা হয়। ঐদিন কনে বরের বাড়িতেই অবস্থান করে। ২/১ দিন পরে কনে পালাই-এর বাড়িতে যায় এবং তার সমস্ত জিনিসপত্রসহ বরের বাড়িতে ফিরে আসে। লুসাই সমাজের প্রথা অনুযায়ী আগস্ট মাসে বিবাহ অনুষ্ঠান করা হয় না। অতীতে লুসাই বিবাহ অনুষ্ঠানে বর জামা ও লুঙ্গি এবং কনে ব্লাউজ ও থামি পরলেও বর্তমানে বর শার্ট-প্যান্ট এবং কনে সাদা গাউন পরিধান করে। লুসাইদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাবিবাহ বিদ্যমান। লুসাইদের মধ্যে জেঠাতো বা কাকাতো ভাইবোনের বিয়ে হতে পারে না। তবে মামাতো ও খালাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়। বর্তমানে খিস্টধর্ম গ্রহণের পরে বিয়ের ব্যাপারে কোনো বাধা না থাকায় অতীতের রীতিনীতি অদ্যাবধি পালিত হয়। অভিভাবক বা যুবক যুবতীর নিজের পছন্দে বিয়ে হলে প্রথম ‘পালাই’ (মধ্যস্থতাকারী) হিসেবে ছেলেপক্ষের কেউ মেয়েপক্ষের নিকট প্রস্তাব পাঠাবে। মেয়ের পিতামাতা ও নানানানী রাজি হলে আলোচনার মাধ্যমে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। লুসাই জনগোষ্ঠী লোকবিশ্বাস তাদের কারো মৃত্যুর পর মৃতের আত্না ‘মিথিখুয়া’ নামক মৃতপূরীতে বাস করে। মিথিখুয়াতে অবস্থানকালে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মফলের বিচার হবে। কর্মফল অনুসারেই তারা স্বর্ণে (পিয়াল রাল) যেতে পারবে। পৃথিবী ছেড়ে মিথিখুয়াতে যাবার মান হিসেবে (থি টিন থ্‌লা) আগষ্ট মাসকেই ধরা হয়। তাই লুসাই সমাজে আগষ্ট মাসে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান বা বিনোদনমূলক উৎসব করা হয় না। বর্তমানেও এ রীতি মানা হয়। লুসাইরা আদিতে সৃষ্টিকর্তা বা পাথিয়েল বিশ্বাস করতো। লুসাই জনগোষ্ঠী এককালে জড়োপাসক ও সর্বপ্রাণবাদের বিশ্বাসী ছিল। তারা ভূতপ্রেত, অপদেবতা ইত্যাদি বিশ্বাস করতো। তারা ভূতপ্রেত ও অপদেবতা উদ্দেশ্যে পশুদিয়ে শির পূজা ও নদী পুজা দিত। অতীতে লুসাইরা যার যার গ্রামে একেক নিয়মে দেবদেবীর পূজা করতো। পরে লুসাইদের মধ্যে খ্রিস্টানধর্ম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে শতভাগ লুসাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় উৎসব পালন ছাড়াও বছরে তারা প্রধান তিনটি উৎসব পালন করে থাকে: ১. চাপচারকূত (বসন্ত উৎসব) ২. মীমতূত (মৃত আত্মাদের স্মরণে) এবং ৩. পলকূত (শস্য কাটার উৎসব)। এছাড়াও রয়েছে চাপচার কুট, মিনকুট, পাল কুট। তাদের মাতৃভাষায় রচিত বিভিন্ন গান ও আদি নৃত্য। মনকুট উৎসব- জুমের ঘাস কাটার যখন শেষ হয় তখন এই উৎসব করা হয়। চাপচার কুট- এটি নবান্ন উৎসব। জুমের ধান কাটা শেষ হলে এই উৎসব করা হয়। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর থেকে মৃতদেহ সৎকারে লুসাইদের নানা আচার এবং মৃত আত্মাদের নিয়ে বিভিন্ন বিশ্বাস এখন আর নেই। খ্রিস্টান ধর্মানুযায়ী প্রার্থনার পর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। যুবকরা কবর প্রস্তুত করে এবং একটি পাথরে মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ এবং তার গ্রাম ইত্যাদি লিখে কবরের উপর মাটিতে পুঁতে রাখে।

১৪) কোচ :

কোচ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে বসবাসকারী অন্যতম প্রাচীন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বর্তমানে কোচ জাতির বিস্তৃতি আদিভূমি কোচবিহার ছড়িয়ে ময়মনসিংহ জেলায় তাদের আবাস গড়ে তোলে । বর্তমানে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী , নালিতাবাড়ী এবং শ্রীবর্দী উপজেলায় তাদের বসবাস। কোচ ও রাজবংশীদের প্রায়সময় একই জাতি মনে করা হয়। কোচ সম্প্রদায় ৮টি দলে বিভক্ত যথা : ওয়ানাং, হরিগাইয়া, সাতপাড়ি, দশগাইয়া, চাপ্রা, তিনথেকিয়া, শংকর ও মারগান। তারা এ দলগুলিকে ভাগ বলে অভিহিত করে। প্রত্যেক ভাগের রয়েছে অনেক গোত্র। কোচরা গোত্রকে নিকিনি বলে। কোচ সমাজ পিতৃপ্রধান। তবে পরিবারের সন্তানসন্তুতি মায়ের গোত্রনাম গ্রহণ করে। পুত্র সন্তানেরাই পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। নিজ গোত্র বা নিকিনির মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। যৌথ এবং একক পরিবার প্রথা চালু থাকলেও বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যাই বেশি। কোন সমস্যার উদ্ভব হলে কোচরা সাধারণত সামাজিকভাবে তা নিরসন করে। কোচ মেয়েরা বিয়ের পর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য স্বামীগৃহে চলে যায়। কোচ মহিলারা সিঁথিতে সিঁদুর পরে এবং হাতে চুড়ির সঙ্গে শাঁখা ব্যবহার করে। কোচ সমাজে একবিবাহ প্রথাই প্রচলিত। তবে কোনো কোনো পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতেও দেখা যায়। কোচদের প্রধান খাদ্য ভাত। তাদের অধিকাংশই আমিষভোজী। তারা শাকসবজি, ডাল, মাছ, ডিম ও মাংস আহার করে। গোমাংস তারা আহার করেনা। শূকরের মাংস তাদের অতি প্রিয়। খরগোশ, সজারু প্রভৃতির মাংস তারা পছন্দ করে। মাছ ছাড়াও কচ্ছপ, কুচিয়া প্রভৃতি তাদের নিকট প্রিয়। রান্নার কাজে তারা তৈল, ক্ষার বা সোডা এবং শুঁটকী মাছ ব্যবহার করে। চালের গুঁড়া এবং সোডা সহযোগে রান্না করা শূকরের মাংস তাদের কাছে উপাদেয়। বিভিন্ন পালাপার্বনে তারা চালের পিঠা তৈরি করে। কোচরা মদপান করে। তবে যারা গুরুর কাছে দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করেছে তারা মদ, মাংস পরিহার করে চলে। দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রীর প্রতি তাদের আগ্রহ স্বাভাবিক। নানা উৎসব কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানে মাছ মাংসের পাশাপাশি তারা ক্ষীর, পায়েস, দই, মিষ্টি প্রভৃতি পরিবেশন করে। কোচ পুরুষেরা ধুতি, লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি প্রভৃতি ব্যবহার করে। কোচ মহিলাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক রয়েছে যা তারা ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার করে। এ পোশাককে লেফেন বলা হয়। কোচ মহিলারা জামা অথবা গেঞ্জির সঙ্গে লেফেন ব্যবহার করে। কোচরা একদিকে যেমন দুর্গাপূজা , কালীপূজা , সরস্বতীপূজা , লক্ষ্মীপূজা সম্পন্ন করে তেমনি আদি ধর্মের দেবদেবীরও পূজা করে । তাদের আদি ধমের্র প্রধান দেবদেবী হলো ঋষি এবং তার পত্মী যোগমায়া। কোচেরা এই দুজনকেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা এবং পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করে। দেবী কামাখ্যাও কোচ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান দেবী। আদি ধর্মের দেবদেবীর পূজা তাদের নিজস্ব পুরোহিতরাই সম্পন্ন করেন। এই পুরোহিতগণকে তারা দেউসী ও আজেং নামে অভিহিত করে। গোত্র পূজার সময় আজেং পৌরহিত্য করেন। ঋষিপূজা এবং গোত্রপূজা বাদেও আজেংদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে গোরভুক্ত যে কোনো ইচ্ছুক ব্যক্তিকে দীক্ষামন্ত্র প্রদান করা যার ফলে সে নিজ গোত্রের গুরু হয়।

১৫) ডালু :

ডালু জাতি হচ্ছে বাংলাদেশে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র জাতির নাম। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও শেরপুরের নালিতাবাড়ি অঞ্চলে ডালু জাতির মানুষদের বাস। তাদের অনেকে মনে করেন মণিপুরিই হচ্ছে তাদের আসল ভাষা । তাদের কথাবার্তায় এমন কিছু শব্দ পাওয়া যায়, যা বাংলা ভাষায় নেই । দীর্ঘদিন বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি বাস করার ফলে, অতীতে তাদের কোন ভাষা থাকলেও এখন তা হারিয়ে গেছে।

১৬) খুমি :

খুমি বাংলাদেশের একটি উপজাতি। এরা খামি নামেও পরিচিত। নামটির অর্থ হলো "সর্বোত্তম জাতি"। আরাকানীরা এদেরকে খেমি জাতি বলে অভিহিত করে থাকে। ১৭শ শতকের শেষভাগে খুমি উপজাতি আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করে। খুমীদের মুল জনগোষ্ঠীর বসবাস মায়ানমারে। গোষ্ঠীগত দাংগার কারণে খুমীদের একটি অংশ মায়ানামার হতে পালিয়ে এসে বান্দরবানের গহিন অরণ্যে বসবাস করতে শুরম্ন করে। তারা সাধারণত প্রকৃতি পূজারী। জুম চাষই তাদের প্রধান জীবিকা। বাংলাদেশে এরা বান্দরবান জেলার রুমা, রৌয়াংছড়ি, এবং থানচি উপজেলাতে বসবয়াস করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান পকেটবুক (১৯৯৯) অনুসারে এদের মোট জনসংখ্যা ১২৪১।

১৭) খিয়াং :

খিয়াং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী একটি সম্প্রদায়। বাংলাদেশের অতিক্ষুদ্রতম আদিবাসী গোষ্ঠির অন্যতম এই খিয়াংয়ের জনসংখ্যা ২,৩৪৫ জন (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। তারা রাঙামাটিপার্বত্য জেলার কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনার কাছাকাছি কিছু গ্রামে বসবাস করে। কিছু খিয়াং বান্দরবন জেলায়ও বসবাস করে। খিয়াং ইতিহাস বা ঘটনাপঞ্জি অনুসারে জানা যায়, যখন তাদের রাজ্য বার্মায় (বর্তমান মায়ানমারে) বার্মিজ দ্বারা তাড়িত হয়েছেন, তখন তারা রাজাসহ চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে। কিন্তু পরে রাজা পুনরায় বার্মায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তার ছোট রাণী গর্ভবতী হওয়ার কারণে তাকে সঙ্গ দিতে পারেননি। রাণী কিছু অনুসারি ও আত্মীয়স্বজন সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে গেলেন। বর্তমান খিয়াং এ-রাণীরই প্রজন্ম ও অনুসারি নিয়ে গড়ে ওঠা জনসম্প্রদায়। খ্রিয়াংরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তাদের কেউ-কেউ ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে।

১৮) রাখাইন :

রাখাইন বাংলাদেশ ও মায়ানমারের একটি জনগোষ্ঠীর নাম। এরা মগ নামেও পরিচিত। আঠারো শতকের শেষে এরা আরাকান থেকে বাংলাদেশে এসে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস মূলত কক্সবাজার, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলায়। এ ছাড়া রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু রখাইন বসতি দেখা যায়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়ও রাখাইন সম্প্রদায়ের বসতি রয়েছে। রাখাইন শব্দটির উৎস পলি ভাষা। প্রথমে একে বলা হত রক্ষাইন যার অর্থ রক্ষণশীল জাতি। রাখাইন জাতির আবির্ভাব হয় খৃষ্টপূর্ব ৩৩১৫ বছর আগে।[২] ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, ১৭৮৪ সালে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে রাখাইনদের আগমন ঘটে। মূলত সেসময় বার্মিজ রাজা 'বোদোপ্রা' আরাকান রাজ্য জয় করে। তার জয়লাভে ভয় পেয়ে বিপুল সংখ্যক রাখাইন সমপ্রদায়ের লোক পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আরাকানের মেঘবতির সান্ধ্যে জেলা থেকে দেড়শ রাখাইন পরিবার বাঁচার আশায় পঞ্চাশটি নৌকাযোগে অজানার উদ্দেশ্যে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেয়। কয়েকদিন পর তারা কূলের সন্ধান পায় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী দ্বীপে। এই দ্বীপে তারা বসতি স্থাপন করে এবং তাদের সঙ্গে করে আনা ধান ও ফল-মূলের বীজ বপন করে সেখানে জমি আবাদ শুরু করে। রাখাইনদের বিভিন্ন দলের নেতৃত্বদানকারী প্রধানগণ ছিলেন ক্যাপ্টেন প্যোঅং, উঃগোম্বাগ্রী ও অক্যো চৌধুরী। কয়েকবছর পর বেশি ফসলের আশায় তারা রাঙ্গাবালী ছেড়ে চলে যান মৌডুবিতে। লোকসংখ্যা বাড়লে তারা ছড়িয়ে পড়ে বড়বাইশদিয়া, ছোটবাইশদিয়া, কুয়াকাটা, টিয়াখালী, বালিয়াতলী, বগীসহ বিভিন্ন দ্বীপ এলাকায়।ক্রমাগত তারা বিলুপ্ত হচ্ছে। বলা যায় বাংলাদেশের উপড়ে বর্নিত এলাকা থেকে তার বিলুপ্ত জাতি। গুটি কয়েকটি পরিবার আছে। অন্যরা বর্তমান মায়ানমার দেশে চলে যাচ্ছে বা গেছে।

১৯)হাজং :

হাজং বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আদিবাসী। বাংলাদেশে এদের বাস নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলায়। এছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও এদের কোন অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায়নি। বর্তমানে এদের সংখ্যা ৩০০০ জনের মত। গত শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এরা খুব দাপটের সাথে বসবাস করেছে। এবং ঐতিহাসিক হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, ইত্যাদির নেত্রিত্বের সারিতে এদের অগ্রণী ভুমিকা ছিল। ব্রিটিশ বিরোধী, জমিদার বিরোধী এসব আন্দোলনে অনেক বিখ্যাত হাজং ব্যক্তিত্বরা অবদান রেখেছেন। কুমুদিনী হাজং এবং যাদুমনি হাজং টঙ্ক আন্দোলন এবং জমিদার বিরোধী আন্দোলনে ব্যপক ভূমিকা রাখেন। এই আন্দোলনে [রাসিমণি হাজং] প্রথম শহীদ হন। অশ্বমনি হাজং এবং ভদ্রমনি হাজং লেংগুড়া বাজারের ঐতিহাসিক টংক বিরোধী মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হন এবং তাদের বারো বছরের জেল হয়।

২০) খাসিয়া :

বাংলাদেশের সিলেট জেলা ও ভারতের আসামে এই জনগোষ্ঠী বাস করে। সিলেটের খাসিয়ারা সিনতেং (Synteng) গোত্রভুক্ত জাতি। তারা কৃষিজীবী। ভাত ও মাছ তাদের প্রধান খাদ্য। তারা মাতৃপ্রধান পরিবারে বসবাস করে। তাদের মধ্যে কাচা সুপারি ও পান খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও এ সম্প্রদায়ের লোকজন শান্তিপ্রিয়। তাদের রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-কানুন। তবে তাদের মধ্যে খাসিয়ারাই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো পুরুষ সম্পত্তির মালিক হয় না। পুরুষদের বিয়ে হলে তারা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওঠে। তারাও এ অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসীর মতো একটি প্রাচীন সম্প্রদায় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন টিলা এলাকায় তাদের বসবাস। দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করলেও তারা অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও সদর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় তারা বসবাস করছে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫০টি খাসিয়া পরিবার বসবাস করছে। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্যরা এ দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে তারা আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে এ আদিবাসীরাই অনার্য বলে পরিচিতি লাভ করে। আর্য-অনার্য যুদ্ধে অনার্যরা পরাজিত হয়ে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। পরে এ গহিন বনেই তারা বসবাস শুরু করে। ফলে তারা শিক্ষা দীক্ষা ও আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকে। খাসিয়াদের সাংস্কৃতিক জীবন বেশ সমৃদ্ধ। তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো খুব আকর্ষণীয়। তাদের ভাষায় রচিত গানগুলোও হৃদয়ছোয়া।

২১) পাংখোয়া :

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩টি অদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম। পার্বত্য রাঙামাটি জেলার সাজেক উপত্যকা থেকে বান্দরবানের রুমা পর্যন্ত এবং পাশ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম রাজ্য সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় পাংখোয়া জাতির বসবাস রয়েছে। পাংখোয়া জনগোষ্ঠী নিজেদের ধর্মবিশ্বাসে বৌদ্ধ বলে দাবি করে থাকে। তবে একাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো প্রকৃতি উপাসনাও পাংখোয়া সমাজে প্রচলিত। তাদের সৃষ্টিকর্তার নাম ‘পত্যেন’, যেমন লুসেইদের ‘পুথিয়ান’। বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে তাদের সমাজে অনেক পৌরাণিক গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। সৃষ্টিকর্তা ‘পত্যেন’-এর পরই তাদের প্রধান উপাস্য দেবতার নাম ‘খোজিং’। অরণ্যের কর্তা এই দেবতা জুমচাষের ভালমন্দও নিয়ন্ত্রণ করেন বলে এর উদ্দেশেই অধিকাংশ পূজাপার্বণ, ব্রত-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বাঘ খোজিং দেবতার পোষা প্রাণি ছিল বলে পাংখোয়াদের চোখে বাঘের স্থান উঁচুতে। খোজিং-এর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বৈশাখের শুরুতে নৃত্যানুষ্ঠানের রীতি প্রচলিত রয়েছে। পাংখোয়াদের বিশ্বাস, গভীর অরণ্যে খোজিং দেবতার অবস্থান। মূল খোজিং পূজা শ্রাবণ মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই পূজা পাংখোয়া সমাজে সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়। পাহাড়ে জুমচাষ এবং অরণ্যে শিকার এই দুইয়ের উপর এদের জীবন নির্ভরশীল। জুমচাষের পদ্ধতি এদের মধ্যে এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ধান এবং অন্যান্য শস্য ফলানো পাংখোয়াদের কৃষিকাজের মূল উদ্দেশ্য। তবে তারা জঙ্গল থেকে গাছ কেটে কাঠ আহরণের কাজও করে থাকে। এসব কাজে নারী সমানভাবে পুরুষের সঙ্গে অংশ নেয়। হাট-বাজার মূলত মেয়েরাই করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই পাংখোয়া নারীরা কোমর-তাঁতের মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজনীয় বস্ত্র বুনে আসছেন। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে পাড়া ও প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করে কিংবা বিনিময় প্রথার বাইরে সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করেন। পাংখোয়াদের বাঁশ ও বেত শিল্প সর্বজন সমাদৃত। বাঁশ ও বেতের তৈরি এসব সামগ্রীতে তাদের শৈল্পিক নৈপূণ্য ফুটে উঠে। পাংখোয়া সমাজে পিতাই পরিবারের প্রধান। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তানরা পারিবারিক বিষয়-আশয়ের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। পাংখোয়া জনগোষ্ঠী দুটো গোত্রে বিভক্ত পাংখোয়া ও ভানজাঙ। গোত্রান্তরে বিয়েতে কোন বাধা নেই। পরিণত বয়সে পিতামাতার মতামত অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। পাংখোয়াদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন নেই। এদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিধবা বিবাহের প্রচলন রয়েছে। পাংখোয়াদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে, তবে তা মৌখিক ভাষা। এদের ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই। তা সত্ত্বেও ঐ ভাষায় গানের অভাব নেই, বিশেষ করে প্রেমের গান। অলিখিত রূপ নিয়েই এদের লোকসঙ্গীত যথেষ্ট সমৃদ্ধ। ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও পূজাপার্বণ নিয়ে পাংখোয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। নাচ ও গান তাদের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। বাঁশনৃত্য, পুষ্পনৃত্য এবং আরও কিছু বিশেষ নৃত্যগীতে তারা অভ্যস্ত। পাংখোয়া জনগোষ্ঠীতেই মৃতদেহ কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত।